একটি দেশ কেন ইচ্ছামতো নোট ছাপিয়ে ধনী হয়ে যায় না?


ইশ….. যদি একটা টাকার গাছ থাকতো! কি যে ভালো হতো! ইচ্ছা হলেই গাছ ধরে ঝাঁকাতাম। আর টাকার পাতা গুলো ঝড়ে ঝড়ে পড়তো! সেই টাকাগুলো কুড়িয়ে নিতাম। তারপর যা ইচ্ছা তাই করতাম!
কেন যে টাকার গাছ হলো না! ধুর!
ছোটোবেলা থেকে এই চিন্তা কি কখনও মাথায় আসে নি কারও? অবশ্যই এসেছে। আমার মতো আরও অনেকে মাথাতেই এই চিন্তা এসেছে!
টাকার গাছ তো নেই! তাহলে টাকা আসে কোত্থেকে? টাকা বা মুদ্রা আসে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের নির্দেশে দেশের চাহিদা অনুযায়ী টাকা বানায়। কিন্তু সরকার চাইলেই তো যত ইচ্ছা তত টাকা বানিয়ে নিতে পারে! টাকা আর তেমন কি! প্রিন্ট করা কতগুলো কাগজই তো! তাহলে কেনো সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছা মতো টাকা বানায় না? এটাও কিন্তু একটা ভাববার বিষয়।
তাহলে একটু চিন্তা করে দেখি , এই প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক কোনো উত্তর পাওয়া যায় কি না!

ধরা যাক বাসায় জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে। ১০০ লোকের আয়োজন। তাই বিশাল একটি কেক আনা হলো। কিন্তু পার্টি টাইমে দেখা গেলো লোক সংখ্যা আরেকটু বেশি। ১১০। এবার কী করা যায়? যে কেকটিকে ১০০ পিস করার কথা ছিলো সেটি এখন ১১০ পিস করলেই তো হয়ে যাবে, তাইনা? অর্থাৎ লোকসংখ্যা বাড়লেও ভাগ করতে হবে কিন্তু সেই একটি কেকই। এখানে উদাহরণে থাকা একটি কেক হলো দেশের সম্পদ আর লোকসংখ্যা হলো সম্পদের মূল্য। অর্থাৎ টাকা ছাপিয়ে যতই বাড়ানো হোক না কেন সম্পদের পরিমাণ তো একই থেকে যাবে। ফলে যা হবে তা হলো, পণ্যের বিপরীতে তার দাম বেড়ে যাবে। ঠিক যেমন পুরো একটি কেকের বিপরীতে লোকসংখ্যা বেড়ে গিয়েছিলো।

এবার আসি বৈদেশিক লেনদেনের বিষয়ে। ধরা যাক আমাদের দেশে মোট পাঁচটি স্বর্ণের বার আছে যাদের মূল্য প্রতিটি ২০ টাকা করে মোট ১০০ টাকা । এইদিকে ডলারের হিসেবে এই বারগুলোর মোট মূল্য ধরা যাক ৫০ ডলার। তাহলে কী হলো? আমাদের ১০০ টাকা বৈদেশিক ৫০ ডলারের সমমান। এইক্ষেত্রে আমরা যদি ডলার কিনতে যাই, আমাদের কে কিন্তু প্রতি ডলারের বিপরীতে ২ টাকা করে দিতে হবে।
এখন সরকার হঠাৎ করে অর্থ ছাপিয়ে দেশের অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দ্বিগুন করে ফেললো। এবার আমাদের সেই ৫ টি বারের মূল্য দাঁড়াবে ২০০ টাকা। এদিকে ডলারের হিসেবে কিন্তু ৫০ ডলারই আছে। তাহলে কী দাঁড়াবে? প্রতি ডলারের মূল্য বেড়ে এখন হয়ে যাবে চার টাকা। এভাবে প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যই কিন্তু দেশের মুদ্রার হিসেবে বেড়ে যাবে। বৈদেশিক মূদ্রার মূল্য বেড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই কোনো দেশের জন্যে সুখকর না। কারণ দেশের যত উন্নয়ন মূলক কাজ বৈদেশিক ঋণ নিয়ে করা হয় সব তো বৈদেশিক মুদ্রার হিসেবেই হয়। তাহলে, দেশের নিজস্ব মুদ্রা বা টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে ঋণ কিন্তু সেই বেশি মূল্য হিসেবেই পরিশোধ করতে হবে । আদতে দেশের টাকা বেড়ে গেলে সবাই ধনী হয়ে যাবে এরকম ব্যাপার কিছু ঘটবে না।
মাঝখান থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে আমাদের ঘুরতে হবে। যে কোনো কিছুর মূল্য হিসেবে অনেক অনেক টাকা পরিশোধ করতে হবে। কেমন হবে যদি একটি কলম কিনতে গেলে এক বস্তা টাকা দিতে হয় দোকানীকে? যেহেতু অনেক অনেক টাকার বিপরীতে প্রতিটি পণ্যের মূল্য অনেক অনেক বেড়ে যাবে।

জিম্বাবুয়ের কয়েকটি ছবি দেখা যাক চলুন, যেখানে জিম্বাবুইয়ানদের শিশু থেকে শুরু করে সবার হাতে অনেক অনেক জিম্বাবুইয়ান ডলার। তারা সবাই বিলিয়নিয়ার। ঠেলাগাড়ি, ঝুড়িতে করে টাকা বহন করছে এতো টাকার মালিক তারা।

এই শিশুটিও কত্ত টাকার মালিক!
টাকার অভাব নাই।

ছবির মতো করে এইভাবে এতো এতো টাকা বহন করা তো ভীষণ ঝামেলার। এক্ষেত্রে অনেক বড় বড় অংকের নোট ছাপালেই তো আর বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে ঘুরতে হয় না, তাই না? বিলিয়ন ট্রিলিয়ন নোট দিয়ে আমরা লেনদেন করবো। তখন হয়তো একজন দিনমজুর, শ্রমিক থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেনীর নাগরিক সবাই হয়ে যাবো বিলিয়নিয়ার, ট্রিলিয়নিয়ার। আমরা যখন উপার্জন করবো, দেশে অনেক টাকা থাকায় তখন শ্রম বা মেধার বিনিময়ে বেশি টাকাই উপার্জন করবো। এই বেশি টাকা হয়তো নোটের দিক থেকে অনেক মনে হবে কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তা হবে নগণ্য।

ঠিক যেমন ঘটনা ঘটে আসছে জিম্বাবুয়েতে সেই ২০০৮ সাল থেকে। একজন শ্রমিক জিম্বাবুইয়ান ডলারে ২০০ বিলিয়ন জিম্বাবুইয়ান ডলার মজুরি পেলেও, মার্কিন ডলারে তার মূল্য ছিলো মাত্র ৬০ সেন্ট। হাসপাতালের একজন নার্সের বেতন ১২ হাজার ৫৪২ জিম্বাবুইয়ান ডলার হলেও মার্কিন ডলারে তার পরিমাণ ছিলো মাত্র ১২ সেন্ট। এইরকম প্রতিটি পেশায়ই বিলিয়ন ট্রিলিয়ন জিম্বাবুইয়ান ডলার পাওয়া গেলেও আন্তর্জাতিক বাজারে তার মান ছিলো খুবই নগণ্য। অথচ এক টুকরো রুটি কিংবা এক কাপ চা খেতে চাইলে ঝুড়ি ভর্তি টাকা নিয়ে যেতে হয়।

জিম্বাবুয়ে সরকার এই সমস্যা সমাধানের জন্যে ৫০ বিলিয়ন জিম্বাবুইয়ান ডলার, ১০০ ট্রিলিয়ন জিম্বাবুইয়ান ডলারের মতো অনেক বড় বড় নোটের মুদ্রা ছাপিয়েছিলো। যাতে করে জনগণ অনেক বড় বড় মুদ্রা ব্যবহার করে তাদের দৈনন্দিন লেনদেন চালাতে পারে। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে এই মুদ্রার মান ছিলো একদম কম। ১ এর পর ১৪ টি শূণ্য বসিয়ে, সবচেয়ে বড় যে জিম্বাবুয়ের ডলার বানানো হলো, ইউ এস ডলারে তার পরিমাণ সামান্য। কি ভয়ঙ্কর না?

১ এর পর মাত্র ১৪ টি শূণ্য দিয়ে ছাপানো সবচেয়ে বড় নোট।

তাহলে আমরা দেখলাম, অনেক নোট ছাপানো হলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে।

এবার সরকার যদি ভাবে, যে কোনো ভাবেই হোক দেশে মুদ্রাস্ফীতি হতে দেবে না, কিন্তু অধিক পরিমাণ মুদ্রা ছাপিয়ে জনগণকে সরবরাহ করে তাদের দারিদ্র্য দূর করবে।তখন মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে হয়তো সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়তে দেবে না।ফলে কী হবে? সবার কাছে বিপুল টাকা থাকার কারণে সবার ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যাবে। তারা অল্প সময়ে বাজারের সব নিত্যপণ্য কিনে ফেলবে। ফলে বাজারের এই পণ্যগুলো দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে। প্রয়োজনে হয়তো হাতে অনেক টাকা থাকবে কিন্তু কেনার মতো পণ্য বাজারে থাকবে না। তখন হয়তো নিজেদেরকে জিম্বাবুইয়ানদের মতো ” Starving Billionaire” প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে।

তখন হয়তো মনে হবে, ভাই আর বেশি টাকা চাই না, আমরা ঠিকমতো খেয়ে পরে একটু বাঁচতে চাই। বোঝা যাবে, ধনী হতে টাকা নয়, শ্রম আর মেধার ব্যবহার কতটা জরুরি।

এবার একটু ভেনিজুয়েলার দিকে তাকানো যাক। ২১ আগস্ট, ২০১৮ তারিখে BBC এর একটি প্রতিবেদনে রয়টার্সের ফটোগ্রাফার কার্লোস গার্সিয়া রলিন্স এর তোলা কয়েকটি ছবি প্রকাশ করা হয়। যেখানে দেখা হয়েছে, প্রতিদিনের খাবার আর ব্যবহার্য দ্রব্যের বিপরীতে ভেনিজুয়েলা বাসিন্দাদের কত বলিভার খরচ করতে হয়।

তাদের অত্যাধিক মুদ্রা ছাপানোর ফলে পণ্যের দাম এতো বৃদ্ধি পেয়েছে যে, ভেনিজুয়েলার বেশিরভাগ মানুষই বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে এখন আর তাদের দেশীয় মুদ্রা বলিভার ব্যাবহার করছেন না। তারা মার্কিন ডলার, ইউরো, ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বার্টারিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে ভেনিজুয়েলার দেশীয় মুদ্রা বলিভার এখন অচল মুদ্রায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

১৯২৩ সালের কথা। ফরাসি আক্রমনের পর পর। ঐ সময়টায় ওয়েমার ( আধুনিক জার্মান সরকার) সৈন্য, বন্দুক এবং গোলাবারুদের অর্থ প্রদানের জন্য তৎকালীন জার্মান মুদ্রা “পেপারমার্ক” অবাধে ছাপিয়েছিল। এর ফলে তাদের অর্থনৈতিক সুবিধা তো হয়ই নি। বরং সার্বিক মূল্য কমেছে। ১৯২২ সালে, যেখানে একটি রুটির দাম ১৬৩ মার্ক ছিল, ১৯২৩ সালের নভেম্বরে, সেখানে একটি রুটির দাম হয়ে যায় ২০০,০০০,০০০,০০০ মার্ক। এই “পেপারমার্ক” পরবর্তীতে এতোটাই মূল্যহীন হয়ে পড়ে যে, বাচ্চারা সেগুলো দিয়ে খেলতে শুরু করে।

সূত্রঃ https://historydaily.org/germany-hyperinflation





https://historydaily.org/germany-hyperinflation

তার মানে বোঝা যাচ্ছে, ধনী হবার জন্যে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা বা টাকা তৈরি করে জনগণের মাঝে সরবরাহ করা কোনো বুদ্ধির কাজ নয়। বরং একটি দেশের অর্থনীতির জন্যে ভয়ংকর পরিণতি। অর্থনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে উঠার জন্যে যে মুদ্রা ছাপানো হবে, তা দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে এতোটাই বিপর্যস্ত করে তুলবে যে সরকার হয়তো সেই মুদ্রা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে।

অনেক বেশি টাকা জনগণের হাতে পৌছালে বিলিয়নিয়ার ট্রিলিয়নার হওয়া সহজ, কিন্তু দিন শেষে হয়তো সেই মুদ্রাগুলো অচল মুদ্রায় পরিণত হবে।

পরিশেষে, টাকা বা মুদ্রা হলো সম্পদের মূল্য পরিমাপের একটা মাধ্যম মাত্র। আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যম নয়। তাই দেশের দারিদ্র্য কমাতে হলে, আর্থিকভাবে লাভবান হতে চাইলে দেশের মোট সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে হবে। নিজেদের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে সম্পদ তৈরি করতে হবে। পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি পরিকল্পিত আমদানি, রপ্তানির মাধ্যমে আয় উপার্জন আর সম্পদ বাড়াতে পারলেই দেশের আর্থিক ও সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব।

এখন তো বলতেই হয়, ভাগ্যিস টাকার গাছ নাই৷ ভাগ্যিস টাকা বানানোর মেশিন থাকা সত্বেও সরকার ইচ্ছামতো টাকা ছাপায় না!

WordPress.com News

The latest news on WordPress.com and the WordPress community.