আমার বই ভাবনা


টেক্সট বইয়ের চেয়ে অন্যান্য বই পড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো ছোটোবেলা থেকেই। সুকুমার রায়ের রচনাসমগ্র, শিয়াল পন্ডিত, আরব্য রজনী আর নানান দেশের রূপকথার বইয়ের গন্ডি পেরিয়ে শুরু করলাম তিন গোয়েন্দা। সেই ক্লাস সিক্স এর কথা। তারপর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রতি সপ্তাহের দেশবিদেশের অনুবাদ বইগুলো পড়া। তার অনেক দিন পর ক্লাস টেন এ উঠে শুরু হলো বড় বড় উপন্যাস। কত যে বকা খেয়েছি এই বই পড়া নিয়ে তা আর নাইই বা বললাম। কত কত ভালো লাগার বই আছে। কোনটা রেখে কোনটার নাম বলি। প্রথমদিকের প্রিয় লেখক ছিলেন হুমায়ুন আহমেদ আর মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
তারপর প্রিয় লেখকের তালিকায় যোগ হতে থাকলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবী। এখন সবচেয়ে ভালো লাগে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।
আজ আমি দুইটি উপন্যাস নিয়ে আমার মনের কথা শেয়ার করবো।হুমায়ুন আহমেদ এর “নন্দিত নরকে” আর “পারাপার “। একান্তই আমার চিন্তা থেকে। আমার চিন্তার সংগে অন্য কারও চিন্তা মতামত নাও মিলতে পারে।

প্রথমে উপন্যাস “পারাপার“।

“আমি কোনো মহাপুরুষ নই। আমার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই।আমি হিমু। আমি অতি সাধারণ হিমু।”
হিমু! কে না চেনে এই লোককে! একজন নগর পরিব্রাজক যে কি না সারাক্ষণ মহাপুরুষ হবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যে হলুদ পাঞ্জাবি পরে পথে পথে খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায়। যার পাঞ্জাবিতে কখনো পকেট থাকে না।
পারাপার উপন্যাসটি হিমু সিরিজের একটি উপন্যাস। হিমু যাদের অসম্ভব প্রিয় চরিত্র, তাদের জন্যে এই বইটা নিঃসন্দেহে ভালো লাগার। অন্যরা পড়লেও কিন্তু ভালো লাগবে।
একজন নিষ্পাপ পবিত্র মানুষের রক্ত খোঁজা নিয়ে এই উপন্যাস এগিয়েছে। ধনকুবের ইয়াকুব আলীর ধারণা, পবিত্র আর নিষ্পাপ মানুষের রক্ত পেলেই তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করবেন।
হিমু কি পারবে সেই পবিত্র মানুষটির খোঁজ দিতে?
হিমুর বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা অসাধারণ। সে হেলাফেলা করে যা বলে অনেক সময় তাইই সত্যি হয়ে যায়। আবার সিরিয়াসলি কিছু বললে তা হয় মিথ্যা।
কিন্তু তারপরেও সবাই ভাবে হিমু তার অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে হয়তো সমস্যার সমাধান করে ফেলবে।
মৃত্যু পথযাত্রী ইয়াকুব সাহেব সেইরকম বিশ্বাস থেকেই হিমুর খোঁজ করলেন। হিমুও নিষ্পাপ পবিত্র মানুষ খোঁজার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ফেল
লো। এদিকে ইয়াকুব সাহেবের একমাত্র মেয়ে মিতু আর অন্যান্যরা ভাবলো হিমু হয়তো বা ইয়াকুব সাহেবের দূর্বলতায় বড় অংকের কোনো সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আমরা পাঠকেরা তো জানি হিমু সব ধরনের লোভ লালসার ঊর্ধ্বে।
এদিকে এই দায়িত্ব পাবার পরপরই হিমু একটা খসড়া লিস্ট করে ফেলে। বিশজনের এই লিস্ট ধরে উপন্যাস এগুতে থাকে। এই লিস্ট ধরেই কয়েকজন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বড় খালা, বড় খালু, ভিক্ষুক একলেমুর মিয়া, ব্যাংকার মনোয়ার উদ্দিন।
আরও আছে লালবাগ থানার সেকেন্ড অফিসার মোহাম্মদ রজব খোন্দকার আর পূর্ত মন্ত্রনালয়ে সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট মুনশি বদরুদ্দিন যারা কখনোই ঘুষ খায় নি বলে পরিচিতি আছে।
এই উপন্যাসের তুলনামূলক অনেকটুকু জুড়েই আছে বড় খালা আর বড় খালু। গল্প পড়তে পড়তেই বোঝা যায় তারা আসলেই ভালো মানুষ।
আর ভিক্ষুক একলেমুর এর কিছু দার্শনিক তো কথা তো মনই কেড়ে নেয়। মনে ভাবনার সৃষ্টি করে।
যেমনঃ
“পাপের কোনো বড় ছোট নাই। ছোটো পাপ, বড় পাপ সবই সমান।”
” দুই কিসিমের পাপ আছে। মনের পাপ, আর শরীরের পাপ। ধরেন আমি একটা জিনিস চুরি করলাম। এইটা হইল শরীরের পাপ। চুরি করছি হাত দিয়া। আবার ধরেন মনে মনে ভাবলাম চুরি করব। এইটা মনের পাপ। চুরি না
করলেও মনে মনে ভাবার কারণে পাপ হইল। এই পাপও কঠিণ পাপ।”
কি? ভাবনার উদয় হলো না?
আরও কিছু চরিত্রও এখানে রয়েছে। আলেয়া খালা। উনি কিন্তু হিমুর তেমন পরিচিত নয়। কিন্তু হিমু আলেয়া খালার খুব পরিচিত। আছে আলেয়া খালার মেয়ে খুকী আর নাতনি পলিনের কথা। আছে সুদর্শন যুবক ম্যানেজার মইন, হারানো মানুষ খুঁজে দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন করিমসহ আরও কয়েকজন। তাদের অংশ উপন্যাসে খুব অল্প সময়ের জন্যে হলেও ভালো লেগেছে । ড্রাইভার ছামছু যাকে হিমু সামসু ডাকতে চেয়েছিলো। কিন্তু ড্রাইভার সাহেবের ছামছু নামটাই পছন্দ।
অগাধ সম্পত্তির মালিক ইয়াকুব সাহেবের মেয়ে মিতুকে প্রথমদিকে কঠিন স্বভাবের মনে হলেও উপন্যাসের শেষে কিন্তু সে তার কোমলতার পরিচয়ই দিলো।
আর রূপা তো সবসময়ই অসম্ভব মায়াবতী একজন। নিজেকে রূপার জায়গা কল্পনা করতে চাইলে মনে হয়, আমি কখনোই রূপার মতো হতে পারবো না। রূপার জায়গা থেকে হিমুর প্রতি রাগই বেড়ে যায়। অথচ রূপা মেয়েটা হিমুর প্রতি কী তীব্র ভালোবাসা নিয়ে বসে আছে!সে কখনো হিমুর ডাক উপেক্ষা করতে পারে না।
এই উপন্যাসে দেখা যায়,
হিমুর টেলিফোন পেয়ে হসপিটালে ছুটে এসেছে রূপা। এসে দেখে মুনশি বদরুদ্দিন তার মেয়ে কুসুমকে নিয়ে ভীষণ বিপদে। কুসুম ভীষণ অসুস্থ। রূপা ক্লিনিকে গিয়ে সেই অচেনা অজানা ছোট্ট মেয়েটির চিকিৎসার জন্যে নিঃস্বার্থভাবে ছুটাছুটি করছে সারাক্ষণ ।
এইসময় রূপাকে নিয়ে চমৎকার কিছু অনূভুতি প্রকাশ করেছে হিমু।
“আমি ক্লিনিকে ঢুকলাম। লবীতে রূপা বসে আছে। শুধু একটিমাত্র মেয়ের কারণে পুরাে লবী আলো হয়ে আছে। মানুষের শরীর হল তার মনের আয়না। একজন পবিত্র। পবিত্রতা তার শরীরে অবশ্যই পড়বে। সে হবে আলোর মত। আলাে যেমন চারপাশকে আলোকিত করে, একজন পবিত্র মানুষও তার চার পাশের মানুষদের আলোকিত করে তুলবে।”
হিমু একদিন রূপাকে কথা দিয়েছিলো, পরের পূর্নিমায় রূপাকে নিয়ে জোছনা বিলাস করবে। উপন্যাসের শেষ দিকে হিমু জোছনা বিলাসে যায়ও। কিন্তু কাকে নিয়ে যাচ্ছে? হিমু তো সাধারণত রূপাকে দেয়া কথাগুলো রাখে না। তাহলে হিমুর পাশে কে? সত্যিই রূপা নাকি মিতু?
বিশজন থেকে কাটছাঁট করে শেষে কে হলো সেই নিষ্পাপ ব্যক্তি?
ইয়াকুব সাহেব কি করলেন? হিমুর কঠিন শর্ত পূরণ করে পূণ্যবান ব্যাক্তির রক্ত নিলেন?
নাকি শর্ত পূরণ করতে না পেরে নিজেকে মৃত্যুর কাছে সঁপে দিলেন শেষমেশ?

উপন্যাস “নন্দিত নরকে”।


নন্দিত নরকে । নামটা চোখে পড়লেই মনে কেমন একটা অনুভূতি হয়, তাইনা?
“নন্দিত নরকে” হুমায়ুন আহমেদ এর প্রথম উপন্যাস। এক অসাধারণ সৃষ্টি। আমার কিশোরী জীবনে পড়া হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক উপন্যাস।
পুরো উপন্যাস জুড়ে এমএসসি পড়ুয়া খোকা নামের চরিত্রটি পাঠকের কাছে তাদের জীবনের গল্প শোনায়।মা-বাবা ভাইবোন নিয়ে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের খুব হিসাবী জীবন যাপনের গল্প। তার গল্পে চাকরি পাবার স্বপ্ন ছিলো। চাকরি পেলে কি কি করবে সেই গল্প ছিলো।ছিলো রাবেয়া, মন্টু, রুনু, বাবা মা, পাশের বাসার শীলু সবার জন্যে খোকার অপ্রকাশিত গভীর ভালোবাসা। তাদের নিয়েই ছোটো ছোটো স্বপ্ন সাজাচ্ছিলো সে। কত অপেক্ষার পর চাকরি তো পেলোই। চাকরি পাবার পর ওর সাজানো ইচ্ছাগুলো তো পূরণ হতেই পারতো।কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না কখনও। উপন্যাসে খোকা তো বাবা মা রাবেয়া মন্টু রুনুকে নিয়েই সুখী হতে চেয়েছিলো।সুখ কাছে এসেও কেন ধরা দিলো না! কেনো এমন হলো! এমন না হলেও তো পারতো। এসব ভেবে খুব খারাপ লাগছিলো তখন।।
উপন্যাস পড়তে পড়তে রাবেয়ার জন্যে কী ভীষণ মায়া হয়। পৃথিবীর হিসাব নিকাশ না বোঝা নিস্পাপ এই মেয়েটাই, পৃথিবীর কদর্য রূপ দেখে ফেললো। কি কষ্ট.. কি কষ্ট! রাবেয়ার পরিণতি পড়ে আমি কেঁদেই ফেলেছিলাম।এই ঘটনা আমার মনে কী গভীর ছাপ যে ফেলেছিলো সেই সময়। একটা উপন্যাসও যে চোখে জল আনতে পারে, তার উদাহরণ হলো এই “নন্দিত নরকে” আর আমি।
উপন্যাসের খোকা, মা-বাবা, রাবেয়া, রুনু, মন্টু সবার জন্যে ভালোবাসা৷ ভালোবাসা পাশের বাসার নাহার ভাবি, শীলু আর হারুনের জন্যে।
আমি উপন্যাস পড়ে মনে মনে খুব চাইতাম, এইরকম যেন সত্যি সত্যিই কারও জীবনে না হয়। এটা যেন শুধু উপন্যাসেই বাধা থাকে।
আমার মনে আছে, আমি তখন সদ্য এসএসসি শেষ করা। এইচএসসি প্রথম বর্ষে ক্লাস শুরু হয়েছে দুয়েকমাস। মনটা এতো খারাপ লাগছিলো যে, একদিন ক্লাস শেষে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এক বান্ধবীর সংগেও শেয়ার করেছিলাম পুরো উপন্যাসটা। যেন মনের ভার কিছুটা হালকা হয়। ষোলো বছর বয়সটা কম আবেগী বয়স না। ঐ সময়ে এই উপন্যাস মনে দাগ কাটবেই। এখনও নন্দিত নরকে পড়তে পড়তে মনের গভীর থেকে আপনাআপনি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। উপন্যাসের দুঃখগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত মন কেমন করতে থাকে।
এই বইটা আমার পড়া প্রথম বই, যেটা পড়ে আমি কেঁদেছি। অনেকদিন ধরে বুকের ভেতর হু হু করা শুরু হয় এই বইটা পড়েই। হয়তো এই উপন্যাস পড়েই হুমায়ুন আহমেদ স্যার অনেকদিন ধরে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক হয়ে ছিলেন।
আমি তো নন্দিত নরকে পড়ে কেঁদেছি। আপনি কোন বই পড়ে কেঁদেছিলেন?

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

WordPress.com News

The latest news on WordPress.com and the WordPress community.